কারবালায় ইমাম কাসেম ভুমিকা ও সাহাদাৎ বরন




কারবালার ময়দানে ইমাম কাসেমের অবদান

সূর্য যতই উর্ধ্বে উঠতেছে, তাপ ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইমাম হোসাইন রাঃ এর পরিজনেরা সামান্য পানির জন্য শত জনে জনে বীরপুরুষ এজিদ বাহিনীর হাতে প্রাণত্যাগ করতেছে। ইমাম হোসাইন চারিদিকে চেয়ে দেখলেন, বন্ধুবান্ধবের মধ্যে আর কেউ নেই। রনসজ্জায় সজ্জিত হয়ে জয়লাভের জন্য শক্রুসম্মুখীন হতে আদেশ অপেক্ষায় তার সামনে আর কেউ আসতেছে না। ইমাম হোসাইন এক দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন, হায় ! এত আত্মীয় বন্ধুবান্ধব হারালাম, অথচ পরিবার -পরিজনের পিপাসা নিবারণ করতে পারলাম না। কারবালার মাটিতে রক্তস্রোত বইতেছে, অথচ ফোরাতকূল শক্রুর হাত হতে উদ্ধার করতে পারলাম না।
ইমাম হাসান রাঃ এর পুত্র ইমাম কাসেম চাচা ইমাম হোসাইনের এই কথা শুনে সুসজ্জিত বেশে সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে বিনীতভাবে বলতে লাগলেন, কাসেম এখনো জীবিত আছে। আপনার আজ্ঞাবহ চিরদাস আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অনুমতি করুন, নরপিশাচ কাফের এজিদের সৈন্য বাহিনী নির্মূল করি।
ইমাম হোসাইন বললেন, কাসেম ! তুমি পিতৃহীন ; তোমার মায়ের তুমিই একমাত্র সন্তান। তোমাকে কিভাবে নরপিশাচ কাফের এজিদের সৈন্য বাহিনীর মধ্যে পাঠাব ?
মহাবীর ইমাম কাসেম বললেন, আপনার অনুমতি পেলে এজিদের ভয়ংকর সৈন্য বাহিনীকে তুচ্ছ জ্ঞান মনে করি। কাসেম যদি এই নরপিশাচদের ভয়ে ভীতু হয়, তাহলে আমার পিতা ইমাম হাসান রাঃ এবং আপনার নাম ডুবিবে। অনুমতি করুন, এজিদের হাজার হাজার সৈন্য বাহিনী বিনাশ করে আসি।
ইমাম হোসাইন রাঃ বললেন, প্রাণপ্রিয় কাসেম ! আমার বংশের তুমিই সকলের প্রধান, আমার পরে তুমিই মুসলিম জাহানের খলিফা, তুমি ইমাম বংশের অমূল্য রত্ন। তুমি তোমার মায়ের একমাত্র সন্তান, তাহার সামনে থেকে তাকে এবং সমুদয় পরিবার পরিজনকে সান্ত্বনা দাও। আমি নিজেই যুদ্ধ করে ফোরাত নদী উদ্ধার করতেছি।
মহাবীর ইমাম কাসেম বললেন, আপনি যাই বলুন, কাসেমের প্রাণ দেহে থাকতে আপনাকে অস্ত্র ধারণ করতে হবে না। কাসেম কাফের এজিদের সৈন্য দেখে কখনোই ভীত হবে না। যদি ফোরাত নদী উদ্ধার করতে না পারি, তবে ফোরাত নদী আজ এজিদের সৈন্য বাহিনীর রক্তে লাল হয়ে যাবে। এই কথাগুলো বলে ইমাম কাসেম ইমাম হোসাইনের পবিত্র কদমে চুমু খেয়ে যুদ্ধে রওনা হল।
ইমাম কাসেম যুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়ে বলতে লাগলেন, যুদ্ধের সাধ যদি কারোর থাকে, তাহলে কাসেমের সামনে আস। সেনাপতি ওমর পূর্ব থেকেই কাসেমকে বিশেষভাবে চিনেন। কাসেমের তরবারির সামনে দাড়াইতে পারে এমন বলবান বীর তার সৈন্যদের মধ্যে একমাত্র বর্জক ছাড়া আর কেউ নাই।
বর্জককে ডেকে ওমর বললেন, ভাই বর্জক ! হাসান পুত্র কাসেমের সাথে যুদ্ধ করতে আমাদের সৈন্যদের মধ্যে তুমি ভিন্ন আর কেউ নাই। ভাই মহাবীর কাসেমের সামনে যাকে পাঠাব, সে আর শিবিরে ফিরে আসবে না। আমি নিশ্চয়ই বলতে পারি, কোনভাবেই সে আর কাসেমের হাত থেকে রক্ষা পাবে না। নিরর্থক সৈন্য ক্ষয় করা মানে হয় না। আমার বিবেচনায় তুমিই কাসেম অপেক্ষা মহাবীর। তুমিই কাসেমের জীবন প্রদীপ বিনাশ করে এসো।
বর্জক বললেন, বড় ঘৃণার কথা ! শামদেশে মহা মহা বীরের সামনে আমি দাড়াইছি, আজ পর্যন্ত কেউ সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিতে সাহস পায় নাই। এখন কিনা এই সামান্য বালকের সাথে ওমর আমাকে যুদ্ধ করতে আদেশ করেন। বড়ই ঘৃণার কথা ! হোসেনের সাথে যুদ্ধে দাড়াইলে বরং কিছুটা শোভা পায় ; আর এ কিনা কাসেমের সাথে যুদ্ধ। বালকের সাথে সংগ্রাম ! কখনোই না, কখনোই না ! কখনোই আমি কাসেমের সাথে যুদ্ধ করতে যাব না।
ওমর বললেন, তুমি কাসেমকে জান না। তাকে অবহেলা করো না। তার তুল্য মহাবীর মদিনায় আর কেউ নাই। ভাই বর্জক ! তুমি ভিন্ন কাসেমের অস্ত্রের আঘাত সহ্য করে এমন বীর আমাদের দলে আর কে আছে ?
হাসতে হাসতে বর্জক বললেন, কাকে তুমি কি কথা বল। ক্ষুদ্র কীট, ক্ষুদ্র পতঙ্গ কাসেম ; তার মাথা কেটে আমি কি বিশ্ববিজয়ী বীর হাত কলংকিত করব ? কখনোই না, কখনোই না ! সিংহের সাথে সিংহের যুদ্ধ হয়, শিয়ালের সাথে সিংহ কোন কালে যুদ্ধ করে না ওমর ? সিংহ -শিয়াল ! তুলনা করলে তাও নয়। বর্জক সিংহ, কাসেম একটা কীট পতঙ্গ মাত্র। কি বিবেচনায় তুমি এই তুচ্ছ পতঙ্গ কাসেমের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করতে পাঠাও ? আচ্ছা, তোমার যদি বিশ্বাস হয়ে থাকে কাসেম মহাবীর, আচ্ছা, আমি যাব না। আমার চার পুত্র বর্তমান, তারা রণ ক্ষেত্রে গমন করুক, এখনই কাসেমের মাথা কেটে আনবে। আমি বরং এই আনন্দে আল্লাহর দরবারে দুই রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করি।
আদেশমত বর্জকের প্রথম পুত্র যুদ্ধে গমন করল। যুদ্ধ ক্ষেত্রে বর্শা চালাইতে আরম্ভ করল। বিপক্ষে পরাস্ত হলো না। অবশেষে তলোয়ার যুদ্ধ ! সামনে মহাবীর ইমাম কাসেম। উভয়ে মুখোমুখি হয়ে দন্ডায়মান আছেন। বর্জকের পুত্র অস্ত্র প্রহার করতেছে কাসেম হাসতেছে। বর্জকের পুত্র কাসেমের মাথা লক্ষ্য করে অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। অস্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেল। পুনরায় আঘাত করল। ইমাম কাসেমের চামড়া বিদ্ধ হয়ে বাম হাত হতে রক্তের ধারা ছুটিল। বর্জক পুত্র বর্শা ধারণ করে বলল, কাসেম ! তলোয়ার রাখ। অসি যুদ্ধে তুমি এখন অক্ষম। বর্শা ধারণ কর, তোমার নিকট বর্শাযুদ্ধই এখন মঙ্গল।
ইমাম কাসেম বর্জক পুত্রের বুক লক্ষ্য করে বর্শা নিক্ষেপ করল। সেই বর্শা বর্জক পুত্রের বুক ছিদ্র করে বের হয়ে গেল। বর্জক পুত্র ঘোড়ার পিঠ হতে মাটিতে পড়ে গেল। ইমাম কাসেম বলতে লাগল, ওরে মোনাফেক কাফেরগণ ! আর কারে যুদ্ধ ক্ষেত্রে কাসেমের সামনে পাঠাবি, পাঠা।
পাঠাইবার আর বাকী রইল না। দেখতে দেখতে মহাবীর ইমাম কাসেম বর্জকের অপর তিন পুত্রকে মাথা কেটে নরকে প্রেরণ করেন। পুত্র শোকে বর্জক সেনাপতির আদেশের অপেক্ষা না করে সিংহ গর্জনে স্বয়ং যুদ্ধ ক্ষেত্রে দেখা দিলেন। বীরদর্পে বলতে লাগলেন, কাসেম ! তুমি ধন্য ! ক্ষণকাল অপেক্ষা কর। তুমি আমার চারটি পুত্র হত্যা করেছ, তাতে আমার দুঃখ নাই। কাসেম ! তুমি বালক। এত যুদ্ধ করে অবশ্যই ক্লান্ত হয়েছ। সপ্তাহকাল ধরে তোমার পেটে খাবার নাই কন্ঠে পানি নাই, এ অবস্থায় তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করা কেবল বিড়ম্বনা মাত্র।
মহাবীর ইমাম কাসেম বললেন, বর্জক ! সে ভাবনা তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি পুত্র শোকে দুর্বল হয়ে গেছ, এখন তোমার পক্ষে যুদ্ধ করা সম্ভব না।
পাপিষ্ঠ কাফের বর্জক বললেন, কাসেম ! আমি তোমার কথা স্বীকার করি, পুত্র শোকে অতি কঠিন হৃদয়ও দুর্বল হয় ; কিন্তু বীর হৃদয়ে দুঃখই বা কি আর কষ্টই বা কি ? আমি এখনই পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিব, প্রতিশোধের আগুন আমার বুকের ভিতর দাউ দাউ করে জ্বলছে।
পাপিষ্ঠ কাফের বর্জক মহাক্রোধে বর্শা ঘুরাইয়া বলতে লাগল, কাসেম ! তোমার বীরত্ব এই মুহূর্তে শেষ করতেছি ! তুমি নিশ্চয় জেনে রাখ, বর্জকের হাত হতে আজ তোমার রক্ষা নাই। এই বলে সজোরে বর্শা দিয়ে আঘাত করল। মহাবীর ইমাম কাসেম বিশেষ কৌশলে বর্জকের আঘাত ফিরাইয়া, পাল্টা আঘাত করলেন। তরবারির ঘাত-প্রতিঘাতে উভয়ের বর্ম হতে আগুন ঝরতে লাগল।
কাসেমকে ধন্যবাদ দিয়ে বর্জক বললেন, কাসেম ! আমি রুম, শাম,মিশর,আরব এবং আরো বহু দেশে বহু যোদ্ধার তরবারি যুদ্ধ দেখেছি, কিন্তু তোমার ন্যায় তরবারিধারী বীর যোদ্ধা আমি কখনো দেখি নাই। ধন্য তোমার বাহুবল ! যা হোক কাসেম ! এই আমার শেষ আঘাত। হয় তোমার জীবন, না হয় আমার জীবন। এই কথা বলে বর্জক কাসেমের মাথা লক্ষ্য করে তরবারি দিয়ে আঘাত করলেন। ইমাম কাসেম সে আঘাত তাচ্ছিল্যভাবে সামলে নিলেন এবং বর্জক সরতে সরতে তার গলায় তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলেন। ইমাম কাসেমের আঘাতে বর্জকের মাথা মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। এই ভয়াবহ ঘটনা দেখে এজিদের সৈন্য মধ্যে মহা হুলস্থূল পড়ে গেল।
বর্জকের করুন মৃত্যু দেখে কেউ আর ইমাম কাসেমের সামনে আসতে সাহস পেল না। ইমাম কাসেম অনেকক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করে, এজিদের সৈন্যদের দেখতে না পেয়ে একেবারে ফোরাত নদীর তীরে এসে উপস্থিত হলো। নদী রক্ষকরা মহাবীর ইমাম কাসেমকে দেখে আতংকিত হয়ে গেল। কাসেম কাউকে কিছু বলল না। তরবারি, তীর এবং বল্লম দ্বারা সবাইকে কচুকাটা করতে লাগলেন এবং ফোরাত নদী উদ্ধার হওয়ার উপক্রম হলো।
ওমর, সীমার এবং জেয়াদ প্রভূতিরা দেখল, নদীকূল রক্ষীরা কাসেমের অস্ত্রের সামনে কেউ টিকতেছে না। অবশেষে সকল সৈন্যরা একত্রিত হয়ে কাসেমকে চারিদিকে ঘিরে তীর নিক্ষেপ শুরু করল। অনবরত অসংখ্য তীর ইমাম কাসেমের অঙ্গ - পতঙ্গে বিদ্ধ হচ্ছে। ইমাম কাসেমের সাদা বর্নের ঘোড়া তীরের আঘাতে রক্তে লাল হয়ে গেল। আর মহাবীর ইমাম কাসেমও ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে গেল এবং চারিদিকে ঘোর অন্ধকার দেখতে লাগলেন। শেষে নিরুপায় হয়ে ঘোড়ার রশি ছেড়ে দিলেন এবং প্রভু ভক্ত ঘোড়া দ্রুতই যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করে, শিবিরে এসে পৌঁছাল।
ইমাম কাসেমের মাতা হাসনেবানু ও স্ত্রী সখিনা শিবির হতে ঘোড়ার পদধ্বনি শুনতে পেয়ে, বাহিরে এসে দেখলেন কাসেমের সাদা পোশাক রক্তে লাল হয়ে গেছে। ইমাম কাসেম কোনমতে ঘোড়া থেকে নেমে সখিনাকে বললেন, সখিনা দেখ ! তোমার স্বামীর লাল পোশাক দেখ। নরপিশাচ কাফের এজিদের সৈন্যরা আমাকে কি অবস্থা করেছে। আমার সারা শরীরে বিষাক্ত তীর মেরে ক্ষত -বিক্ষত করে ফেলেছে। ওরা কত নিষ্ঠুর ও পাষান। ওরা একবারও চিন্তা করল না, ওরা কাকে মারছে। ওরা কিভাবে মুসলমান হতে পারে। কোন খাটি মুসলমান ইমাম কাসেমের বুকে তীর নিক্ষেপ করতে পারে না।
এই বেশ তোমাকে দেখাবার জন্যই বহুকষ্টে শক্রুদল ভেদ করে এখানে এসেছি। আস, এই বেশে তোমাকে একবার আলিঙ্গন করে প্রাণ শীতল করি। কাসেম এই কথা বলে সখিনাকে আলিঙ্গন করার জন্য হাত প্রসারিত করেলেন এবং সখিনা এগিয়ে এসে স্বামীকে আলিঙ্গন করলেন। সখিনা আজই আমাদের বিয়ে হলো। আর আজকেই আমার মৃত্যু হলো। কি অদৃষ্টের পরিহাস এবং কত নির্মম ইতিহাস। এই কথাগুলো বলতে বলতে মহাবীর ইমাম কাসেমের প্রাণ পাখি চলে গেল।

Comments